অতিথী কলাম

যে ধরণের কুধারণা দোষনীয় নয়

By মেহেরপুর নিউজ

January 29, 2025

-ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন:

একটি বিষয় আমাদের নিকট পরিস্কার হওয়া উচিৎ, সেটা হলো কুধারণার এই বিষয়টি অনেক সময় আমরা ঢালাও ভাবে চিন্তা করে থাকি কিন্তু এই হুকুম কেবল ঐ অবস্থায় যখন কোন মোয়ামেলা করতে না হয়।

চিন্তাশীল ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, যেখানে মোয়ামেলা করতে হয় সেখানে ‘দুরদর্শীতা হচ্ছে বদগুমানী’ হযরতজী ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘মুমিনের সম্বন্ধে ভাল ধারনা রাখ, নিশ্চয় ভাল ধারনা এবাদতের মধ্যে গণ্য। এই হুকুম কেবল ঐ অবস্থায় যখন কোন মোয়ামেলা করতে না হয়। তখন শুধু ভাল ধারনা হতেই কাজ নেওয়া চাই। আবার কারো সাথে যখন মোয়ামেলা করতে হয় তখন ‘দুরদর্শীতা হচ্ছে বদগুমানী’ এই হুকুমের উপর আমল করবে। স্থান, কাল, পাত্রের পার্থক্য না বুঝার কারনে কোরআন হাদীস বুঝার ক্ষেত্রে অনেক সময় ভুল বুঝাবুঝি হয়ে থাকে।(মালফুজাতে হযরতজী মওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি, মালফুজাত নং-১৭১)

একবার খলীফা ওমর  রাযিআল্লাহু আনহু খুতবা দিতে দাঁড়িয়ে বললেন ‘এ লোকসকল! তোমরা শোন’। এই সময় তাঁর দেহে ছিল এক জোড়া কাপড়। সালমান ফারসী রাযিয়াল্লাহু আনহু এই ব্যাপারটি লক্ষ করলেন যে আমীরুল মুমিনীন এক জোড়া কাপড় পড়েছেন অথচ বন্টন করা হয়েছে একটি করে। এতে তার সন্দেহ হল- তবে কি আমীরুল মু’মিনীন নিজের ভাগে কাপড় বেশী নিয়েছেন? কিন্তু কোন প্রমান তার কাছে ছিল না। তথাপি শুধুমাত্র সন্দেহের উপর ভিত্তি করে তিনি বলে উঠলেন, ‘না, আমরা শুনবো না।’ খলীফা ওমর রাদিআল্লাহু আনহু বললেন, ‘শুনবে না কেন?’ সালমান ফারসী রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আপনি তো আমাদের মাঝে একটি করে কাপড় বন্টন করেছনে, অথচ আপনার শরীরে দেখতে পাচ্ছি দুই জোড়া। খলীফা হিসাবে তো আপনাকে বেশী দেওয়া হয়নি।’ এই দুই চাদরওয়ালা ব্যাক্তি যদি একজন এমন হতেন যে যার কথা কেউ এমনি শুনে না, শুনার দরকারও নেই আর যার কথা কেউ মানে না, মানার দরকারও নেই। আর যার কথা শুনতে ডাকাও হয় না, যার কথা মানতে বলাও হয় না, তাহলে এই কথাই ফালতু যে তোমার কথা শুনবো না, তোমার কথা মানবো না। একজন পাবলিক, তার গায়ে দুই চাদর। উনি বললেন তোমার কথা শুনবো না, তোমার কথা মানবো না। ‘তো তোমাকে কে বলেছে শুনতে আর মানতে? আমার কোন ঠেকা নাই যে আমার কথা শুনতে হবে’। সাদাসিধে কথা।

কিন্তু যার কথা শুনতে হয়, মানতে হয়, এই কথা তার জন্যে। আমিরুল ম’মিনিন হযরত ওমর রাদিআল্লাহু আনহু নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনে অভিযোগকারীর কাছে প্রমান তলব করলেন না। বরং নিজেই তৎক্ষনাৎ সবার সামনে প্রমান করলেন যে তিনি নির্দোষ। ওমর রাযিআল্লাহু আনহু বললেন, ‘ভাই! তাড়াহুড়ো না করে এই মজলিসে আমারই পুত্র আবদুল্লাহ আছে, সে কি বলে তা শোন।’ এই বলে তিনি আব্দুল্লাহকে ডাকলন। দ্বিতীয় ডাকে জওয়াব মিলতেই তিনি আব্দুল্লাহকে সম্বোধন করে বললেন, ‘লুঙ্গি হিসেবে যে কাপড়টি আমি পরিধান করেছি তা কি তোমার দেয়া নয়?’ পুত্র ‘হ্যাঁ’ বলে জবাব দিতেই সালমান ফারসী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলে উঠল, ‘হ্যাঁ’ আমীরুল মু’মিনিন! এবার আপনি বলতে পারেন। এবার আমরা শুনব।’

হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুও বিভিন্ন এলাকাতে আমীর বানিয়ে পাঠাতেন আর নিয়মিত খোঁজ-খবর নিতেন যে সে ঠিকঠাক কাজ করছে কি না?

হযরত তাউস রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, একবার হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, বল দেখি, যদি আমি আমার জানামতে সর্বোত্তম ব্যক্তিকে তোমাদের উপর আমীর নিযুক্ত করি এবং তারপর আমি তাকে ইনসাফ করার হুকুমও করি তবে কি আমি দায়িত্ব শেষ করেছি? লোকেরা বললো, হাঁ। তিনি বললেন, না যতক্ষণ না আমি দেখে নিব, সে আমার কথামত কাজ করেছে, কি করে নাই। (কানয, হায়াতুস সাহাবা)

আসওয়াদ ইবনে ইয়াযীদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর নিকট কোন (এলাকা থেকে) প্রতিনিধিদল আসলে তিনি তাদের আমীর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন যে, সে অসুস্থকে দেখতে যায় কিনা? গোলামের কথা শুনে কিনা? যারা নিজেদের প্রয়োজন নিয়ে তার দ্বারে উপস্থিত হয় তাদের সাথে কেমন আচরণ করে? যদি প্রতিনিধিদল কোন বিষয়ে না বলে দিত তবে তিনি সেই আমীরকে পদচ্যুত করে দিতেন। (কানয, হায়াতুস সাহাবা)

হযরত ওমায়ের ইবনে সা’দ আনসারি রাযিয়াল্লাহু আনহু হেমসের গভর্নর ছিলেন। আমিরুল মু’মিনীন হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর ব্যাপারে বললেন ‘আল্লাহর কসম আমার মনে হয় সে আমাদের সাথে খেয়ানত করেছে’ এবং লিখলেন, ‘চিঠি পাওয়া মাত্র তুমি মুসলামানদের গনিমত থেকে যা কিছু জমা করেছ তা সঙ্গে নিয়ে মদিনায় চলে আস’। হযরত ওমায়ের ইবনে সা’দ আনসারী রাযিয়াল্লাহু আনহু চিঠি পড়া মাত্রই নিজের চামড়ার থলির ভিতর পথের খাবার ও অযূর লোটা বেঁধে নিলেন এবং হাতের লাঠি নিয়ে হেমস থেকে পায়দল রওনা হয়ে সোজা মদীনায় পৌছলেন। সম্পদ বলতে তার কাছে আর অন্য কিছুই ছিল না। আমিরুল মু’মিনীন তাকে বাড়ীতে পাঠালেন এবং বললেন, আমার ধারনা হয় ওমায়ের আমাদের সাথে খেয়ানত করেছে। সে নিশ্চয় হেমস থেকে মাল দৌলত এনে পূর্বেই বাড়ীতে পাঠিয়ে দিয়েছে। সুতরাং হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু যাচায়ের জন্য হারেছ নামী এক ব্যক্তিকে একশত দিনার (স্বর্নমুদ্রা) দিয়ে বললেন, অপরিচিত মেহমান হয়ে তার বাড়ীতে যাবে। যদি সচ্ছলতা দেখ তবে ফিরে আসবে আর যদি অভাব অনটন দেখ হবে তাকে এই একশত দিনার দিবে। হারেছ ফিরে এসে ওমায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহুর চরম অভাব গ্রস্ত জীবনের প্রত্যক্ষ বর্ণনা দেওয়ার পর হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু আশ্বস্ত হলেন।

এটাই হলো সতর্কতা। মহান সাহাবী ওমায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহুকে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বার বার সন্দেহ করেছেনে, কসম করে নিজের সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তার নিঃস্ব অবস্থা দেখেও আশ্বস্ত হননি। বাড়ীতে তাজাসসুসের জন্য গোয়েন্দা পাঠিয়েছেন। তারপর বিরত হয়েছেন। জিম্মাদারদের সততা ও দিয়ানতদারী নিশ্চিত করার ব্যাপারে একজন মুসলমানের সুকঠিন দায়িত্ব এভাবেই খলিফা হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু আনজাম দিয়েছেন।

সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু কুফার আমীর ছিলেন। উনার ব্যাপারে আপত্তি উঠল যে নামাযে গাফলতি করেন, বায়তুল মালের হিসাব ঠিকমত রাখেন না-হিসাব ঠিকমত রাখেন না মানে এটার খরচ ঠিকমত করেন না আর যুদ্ধে যান না। তো এরকম তিনটা কথা ছিল। একটা নামাযে গাফলতি, বায়তুল মালের হিসাব ঠিক নয় আর আরেকটা যুদ্ধে যান না। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ঐ অঞ্চলে তদন্তের জন্য লোক পাঠালেন। তারা তদন্ত করে দেখল যে এই আপত্তি মাত্র একজন লোকের। হয়তোবা তার পিছনে আরও দুই-একজন থাকতে পারে আর এটা কোন বড় ধরনের আপত্তি নয়, ব্যাপকভাবে এই ব্যাপারে কথা বলে না, আমভাবে মানুষ উনাকে নির্ভরযোগ্য ভাল মানুষ, শুদ্ধ মানুষই মনে করে। তার ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষন করে মাত্র একজন। একজনই বলা হয়েছে কিতাবে। বা আমরা মনে করলাম যে তার সাথে পাঁচ-দশজন থাকতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু উনাকে ওখান থেকে বরখাস্ত করে দিলেন। তদন্ত করে জানলেনও না যে এই আপত্তি শুদ্ধ কিনা। অথচ উনি আশারায়ে মুবাশশারা। পরবর্তীতে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ওফাতের আগে যে ছয়জনকে নিযুক্ত করলেন যে এই ছয়জন মিলে পরবর্তী আমীর নিযুক্ত করবে, সেই ছয়জনের মধ্যে একজন সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু। যাকে উনি বরখাস্ত করেছিলেন। আর এই কথাও বললেন যে তোমরা যদি চাও তো সা’দকে পরবর্তী আ’মীর বানাতে পার। এই অনুমতি দিলেন। তো যার ব্যাপারে উনার এই মাত্রার আস্থা যে তাকে আ’মীর পর্যন্তও বানানো যায়, একজনের কথার উপর তাকে বরখাস্ত করে দিলেন কেন? উনি যেহেতু ঐ অঞ্চলের প্রধান, তাকে লোকে মেনে চলে, সবাই যেন তার উপর মুতমাইন হয়। হয় এই সন্দেহগুলো দূর করতে হবে আর না হয় উনাকে সরিয়ে দাও।

এজন্য যারা নেতৃস্থানীয়, এদের ব্যাপারে সন্দেহ করা শুদ্ধ, সন্দেহ অমূলক হলেও। হযরতজী ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহির ঐ কথা, ‘মুমিনের সম্বন্ধে ভাল ধারনা রাখ, নিশ্চয় ভাল ধারনা এবাদতের মধ্যে গণ্য। এই হুকুম কেবল ঐ অবস্থায় যখন কোন মোয়ামেলা করতে না হয় । এই নীতি জানা দরকার। এটা একটা একেবারে অন্য কথার বিপরীত জিনিস। এই বিপরীত জিনিস যে অনেক জায়গায় প্রযোজ্য এটাও জানা থাকা দরকার এবং তার প্রয়োগও আছে। আর প্রয়োগ না হলে অনেক সমস্যা হয়।(ড. মুশফিক আহমাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহির বিভিন্ন সময়ের মোজাকারা হতে)

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সঠিক কথার উপর আমাল করার তৈফিক দান করুন। (আমিন)

সংকলকঃ লেখক ও গবেষক।