– মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন:

অনেক অনেক দিন আগের কথা! এক ব্যক্তি তার মৃত্যুর সময় তার ছেলেদেরকে অসিয়ত করল যে, আমি তো আল্লাহর নিকট কোনো নেক আমল জমা রাখিনি। তাই আমি যখন মৃত্যুবরণ করব তোমরা আমার দেহকে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলবে এরপর প্রবল বাতাসের দিন সমুদ্রে উড়িয়ে দিবে। তার অসিয়তমতে ছেলেরা মৃত্যুর পর তার দেহকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে প্রবল বাতাসের দিন সমুদ্রে উড়িয়ে দিল। মহান আল্লাহ্ তা’য়ালা ঐ ছাইগুলো জমা করে তাকে জীবিত করলেন। এরপর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাকে এ কাজে কিসে প্ররোচিত করল? সে বলল, একমাত্র আপনার ভয়ই আমাকে এ কাজ করতে বাধ্য করেছে। তখন আল্লাহ তা’য়ালা তাকে মাফ করে দিলেন।

ভবিষ্যতে কোনো বিপদের আশঙ্কা করে মনে যে অস্বস্তির সৃষ্টি হয় সেটাই ভয়। আর আশা হচ্ছে, দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে কাম্যবস্তু লাভের সম্ভাবনায় আকাঙ্খা বা ভরসা করা।

দুনিয়ার কোন ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি এবং কোন বিষয়কে সামনে রেখে ভয় যদিও তার নেতিবাচক দিক রয়েছে তবে অন্তরে মহান আল্লাহ্ তা’য়ালার কঠোর শাস্তি ও পাকড়াও এর ভয় মানব চরিত্রের অন্যতম গুন যা ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের মূল ভিত্তি।

একবার আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা রাযিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে হঠাৎ কাঁদতে লাগলেন, তার সাথে তার স্ত্রীও কাঁদতে লাগলেন। আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেন কাঁদছ? স্ত্রী বললেন, তোমাকে কাঁদতে দেখে আমারও কান্না চলে এসেছে। স্বামী বললেন, (কান্নার কারণ হল) আমার আল্লাহর এ বাণীটি স্মরণ হল যে, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ এমন নেই, যে জাহান্নামের উপর দিয়ে অতিক্রম করবে না (সূরা মারইয়াম; ৭১)(মুস্তাদরাকে হাকিম)

তবে শুধু ভয় আনেক সময় আল্লাহ হতে দূরত্ব পয়দা করে। যেমন আমরা কোন হিংস্র জীব জন্তুকে ভয় করে তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করি। যদিও এ ক্ষেত্রে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ আছে কিন্তু আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ হতে পালিয়ে থেকে তাঁর ধরা থেকে বাঁচার কোনো সুযোগ নেই। এজন্য আল্লাহকে ভয় করে তাঁর থেকে দূরে সরে না গিয়ে বরং তাঁর নিকটবর্তী হয়ে তাঁর রহমতের আশাবাদী হয়েই তাঁর পাকড়াও তথা আজাব থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহর আজাবের ভয় ও রহমতের আশা পাশাপাশি রাখতে হবে।

পবিত্র কুরআনে কারীমায় মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, ‘আমার বান্দাদের বলে দাও, ‘আমি তো পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আর আমার শাস্তি- সেটাও অতি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি!’(সুরা হিজর; ৪৯-৫০)

অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ তা’য়ালা যেমন ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু, তেমনি তিনি কঠিন শাস্তিদাতাও। একজন মুমিনের দ্বীলের ভিতরে দুইটি প্রকষ্ট থাকবে যার একটিতে থাকবে মহান আল্লাহর ভয় অন্যটিতে থাকবে তাঁর রহমতের আশা।

হজরত আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক যুবকের কাছে গেলেন, যখন সে মৃত্যুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছিল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি নিজেকে কি অবস্থায় মনে করছ? সে উত্তর দিল, ইয়া রসূলাল্লাহ্! আমি আল্লাহর রহমতের আশা করছি, আবার নিজের গুনাহের জন্য ভয়ও পাচ্ছি। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এমন মুহূর্তে যার অন্তরে এ দুটি জিনিস একত্রিত হয় তাকে আল্লাহ্ আশার বস্তুটি দান করে থাকেন আর যে জিনিসটি থেকে সে ভয় পায় সে জিনিস থেকে আল্লাহ তাকে নিরাপদ করে দেন।(তিরমিযী)

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুক রাযিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, ‘কাল কিয়ামতের ময়দানে যদি অদৃশ্য জগৎ থেকে আওয়াজ দেয়া হয়: একজন মানুষ ব্যতীত অপর কেউ বেহেশতে যেতে পারবে না, তখন আমি ধারণা করি এবং প্রবল আশা রাখি যে, সে ব্যক্তি আমিই হবো। আর যদি অদৃশ্য জগতের বাণী এই হয় যে, কেবল একটি মাত্র লোক দোজখে যাবে, তবে আশঙ্কা করছি যে, না জানি সেই লোক আমিই হই’।(কিমিয়ায়ে সা’আদত)

আল্লাহর কঠোর শাস্তি ও পাকড়াও এর ভয় মানুষের অন্তরের চালনাকারী, যা তাকে সকল ভালো কাজের দিকে ধাবিত করে। সকল অকল্যাণ ও বদ-আমল থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর রহমতের ব্যাপকতা, তাঁর মহানুভবতা, তাঁর মাগফিরাতের আশা হচ্ছে সম্মুখবর্তী পরিচালক যা বান্দার হৃদয়কে প্রশস্ত করে দেয়, তাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি পর্যন্ত নিয়ে যায়। বড় বড় নেক-আমল করার হিম্মত ও সাহস বাড়িয়ে দেয়। বদ-আমল থেকে সরিয়ে আনে। আর এটাই হলো গোলামী ও দাসত্বের সারমর্ম। প্রকৃতপক্ষে মানুষের মনে আল্লাহ ভীতি এবং রহমতের আশা সমানভাবে থাকতে হবে।

আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুমিন যদি আল্লাহর কাছে কী আযাব রয়েছে তা জানত তাহলে কেউ তার জান্নাতের প্রত্যাশা করত না। আর কাফির যদি জানত আল্লাহর কাছে কী রহমত রয়েছে তবে তার জান্নাত থেকে কেউ নিরাশ হত না।’(মুসলিম)

বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে পুরা বিশ্ব যখন দিগ্বিদিক হারিয়ে হতবিহব্বল তখন একজন মুমিনের কাজ হচ্ছে, সে হতবিহব্বল হবে না, দিগ্বিদিক হারিয়ে পেরেশান হবে না। সে তার মালিক কতৃক প্রেরিত আজাবকে ভয় করবে আবার তাঁর রহমতের আশাও করতে থাকবে। মনে রাখতে হবে, মহান আল্লাহ্ তা’য়ালা পৃথিবীতে পূর্বেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতীর উপর বিভিন্ন রোগ যেমন, প্লেগ, যক্ষ্মা, কলেরা, ম্যালেরিয়া, বসন্ত প্রভৃতির মাধ্যমে মহামারী প্রেরণ করেছিলেন। আবার নির্দিষ্ট সময় পর তা তুলেও নিয়েছেন। মহান আল্লাহ্ তা’য়ালার সুন্নাত হল তিনি মহামারী যুগযুগ ধরে স্থায়ী করেন না। ঠিক তেমনি বর্তমান বিশ্বে করোনাভাইরাসের যে প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তাও মহান আল্লাহ্ তা’য়ালা নির্দিষ্ট সময় পর তুলে নেবেন। ইনশা’আল্লাহ। আমাদের জন্য করনীয় হল সেই মহান মালিক কতৃক প্রেরিত আজাবকে ভয় করে সমস্ত প্রকার গুনাহে অনুতপ্ত হয়ে তাওবা ইস্তেগফার করা ও নেক আমালের দিকে ফিরে আসা, আর সাথে সাথে তাঁর রহমতেরও আশা করা।

আসুন আমরা সেই মহান মালিকের নিকটে দু’আ করি, হে মালিক! আমরা আমাদের সমস্ত প্রকার গুনাহে অনুতপ্ত হয়ে অপনার দরবারে তাওবা করছি আপনি আমাদের তাওবা কবুল করুন। আপনি আমাদেরকে নিরাশ ও হতাশ করবেন না। আমাদের মন্দের কারণে আমাদেরকে আপনার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করবেন না। আমাদের অপরাধের কারণে আমাদেরকে আপনার অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত করবেন না। (আমিন)